ক্রেতা-বিক্রেতায় মুখরিত ঘিওর নৌকার হাট

বর্ষার আগমনে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় জমে উঠেছে নৌকার হাট। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্রেতা-বিক্রেতায় মুখর হয়ে ওঠে এসব হাট। বিক্রিও হয় শত শত নৌকা। নৌকার হাটের মধ্যে ঘিওরের হাট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 

কালীগঙ্গা আর ধলেশ্বরী নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে ঘিওর ও পাশ্ববর্তী দৌলতপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে ঘিওর উপজেলার বিশাল কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে শত শত নৌকা নিয়ে আসেন বিক্রেতারা। বেচাকেনা চলে রাত পর্যন্ত। বুধবার সরজমিন নৌকার হাটে গিয়ে দেখা গেছে, ক্রেতা-বিক্রেতারা সবাই মুখে মাস্ক পরিহিত এবং যথা সম্ভব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই নৌকার দরদামে ব্যস্ত।

 

মানিকগঞ্জ সদর থেকে আসা মোহাম্মদ আলী বলেন, প্রতি বছরই বর্ষার শুরুতে মাছ শিকার করার জন্য নৌকা কিনতে এ হাটে আসি। এ বছর নৌকার দাম কিছুটা বেশি। শিমুল কাঠের ১১ হাত ডিঙি নৌকা কিনলাম চার হাজার টাকা দিয়ে।

নৌকার ব্যাপারী রঞ্জিত বিশ্বাস বলেন, ঘিওরের নৌকার হাট অনেক বছরের পুরনো। এ হাটে টাঙ্গাইলের নাগরপুর, ঢাকার সাভার, সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা থেকে মেহগনি, কড়ই, আম চাম্বল, রেইন্ট্রি কাঠের শত শত নৌকা আসে। আকার ও মানভেদে প্রতিটি নৌকা বিক্রি হয় তিন থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত।

 

ঘিওর ও দৌলতপুরের ১৫ টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল বর্ষার পানিতে প্লাবিত হওয়ায় নৌকার কদর বেড়েছে। এসব এলাকার মানুষ মানিকগঞ্জ জেলার বৃহত্তম নৌকার হাট ঘিওরে ভিড় করছে নৌকা কিনতে।

 

ঘিওর উপজেলার চার ইউনিয়নের ২০ গ্রাম ও দৌলতপুরের দুর্গম এলাকায় বর্ষায় নৌকা ছাড়া চলাফেরা করা সম্ভব নয়। তাই বর্ষা আসার আগেই এ দুই উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাঠমিস্ত্রীরা নৌকা তৈরি ও মেরামতের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বর্ষা মৌসুমে এ অঞ্চলের মানুষের মালামাল পরিবহন ও চলাচলের একমাত্র বাহন হিসেবে নৌকার ব্যবহার দীর্ঘ দিনের।

 

উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো পারাপারে পুরোদমে ব্যবহার হচ্ছে ডিঙ্গি নৌকা। নৌকাশিল্পের জন্য বিখ্যাত ঘিওরের কারিগরদের তৈরি নৌকা এ উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি হচ্ছে হরিরামপুর, শিবালয়, দৌলতপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়। নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটছে মিস্ত্রিপাড়ার নারী-পুরুষদের।

 

বর্ষার আগমনে মানিকগঞ্জের ঘিওর, দৌলতপুর, শিবালয় ও হরিরামপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকা পানি উঠে গেছে। রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বর্ষার পানি জমে বাড়ির আঙিনায়। এ সময় এসব অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র বাহন হয়ে ওঠে নৌকা।

 

অন্যান্য বছরের মতো এবারো বর্ষার শুরুতেই ঘিওর উপজেলা সদরের প্রধান ঈদগাহ মাঠের নৌকা বিক্রির হাট জমজমাট হয়ে উঠেছে। ওই হাটে ক্রেতাদের জন্য থরে থরে সাজানো রয়েছে বাহারি কয়েক শ’ নৌকা।

 

ঘিওর বাজারের কাঠমিস্ত্রী রবি সূত্রধর, নিলকমল সূত্রধর, মাসুদ ও হারেছ জানান, বর্ষা মৌসুমে তারা নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত। সপ্তাহে তাদের কারখানা থেকে ৮-১০টি নৌকা ঘিওর, দৌলতপুর, বরংগাইল, তরা ও মহাদেবপুর হাটে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে লোহা ও কাঠের দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকা তৈরিতে খরচ বেড়েছে। নৌকার আকার ও প্রকারভেদে তিন থেকে পনের হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে লাভের অংশ আগের থেকে কমে গেছে।

 

কাঠমিস্ত্রি সুবল দাস জানান, তিনি দাদার আমল থেকেই দেখছেন নৌকা বানানো। বর্ষা এলেই ধুমধাম শব্দ হয় মিস্ত্রিপাড়ায়। বর্ষা মৌসুম শুরুর কিছু আগে অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে তারা নৌকা তৈরি শুরু করেন এবং ভাদ্র মাস পর্যন্ত চলে। বর্তমানে ছোট ডিঙি ও কোষা নৌকার কদর বেশি। কড়ই, জাম্বল, আম ও কদম কাঠের নৌকা বেশি চলে। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘সরকারি সুযোগ-সুবিধা না থাকায় আমরা এ ব্যবসায় অনেক কষ্ট দুঃখের মধ্যে টিকে আছি’।

 

ঘিওরের বানিয়াজুড়ি, বালিয়াডাঙ্গা, সিংজুরি ও বেগুন নারচি, দৌলতপুর উপজেলার জিয়নপুর, বাঁচামারা, বাঘুটিয়া, চরকাটারি, খলসি, ধামশ্বর, কলিয়া ও বিনোদপুর এবং শিবালয়ের কয়েকটি গ্রামের মানুষ বর্ষায় জমায়েত হন ঘিওরের নৌকার হাটে।

 

সপ্তাহের প্রতি বুধবার হাটের দিন হওয়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্রেতারা নৌকা সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখেন। এ ছাড়াও প্রায় সারা সপ্তাহজুড়েই কম-বেশি বিক্রি হয় নৌকা।

 

ঘিওর হাটে নৌকা বিক্রি করতে আসা খগেন সূত্রধর জানান, ১০ হাত লম্বা এবং দুই হাত প্রস্থের একটি নৌকার মূল্য তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকা। এরকম ১১/৩ সাইজের নৌকা চার হাজার, ১২/৩ সাইজের সাড়ে চার হাজার, ১৩/৩ সাইজের পাঁচ হাজার, ১৪/৩ সাইজের সাড়ে পাঁচ হাজার এবং ১৫/৩ সাইজের নৌকা বিক্রি করেন সাত/ আট হাজার টাকায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের স্টিলের নৌকা বিক্রি করেন তিনি।

 

 

 

Facebook Comments Box
  • Untitled post 14630
  • Untitled post 14225
  • Untitled post 11155
  • Untitled post 14630
  • Untitled post 14225