অনলাইনে গরু-ছাগল বিক্রি এখন জেলা-উপজেলায়

 

 

 

করোনা মহামারির মধ্যেই এবার পালিত হচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। কোরবানির ঈদ মানে ত্যাগের আনন্দ। সেই কোরবানিকে সামনে রেখে অনলাইনে শুরু হয়েছে পশু ক্রয়-বিক্রয়। শুধু রাজধানী ঢাকা বা অন্যান্য বিভাগীয় শহরে নয়, জেলা এমনকি উপজেলাতেও পশু বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে।

 

গত শনিবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কোরবানির পশু বিক্রির অনলাইন প্লাটফর্ম ‘ডিজিটাল হাটথ উদ্বোধন করা হয়। করোনা মোকাবিলায় ডিএনসিসি, আইসিটি ডিভিশন, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে এই ডিজিটাল হাট বাস্তবায়ন করছে। ক্রেতারা চাইলে ডিজিটাল হাট থেকে ন্যায্যমূল্যে ক্রয়কৃত পশু ঢাকার পাঁচটি এলাকা থেকে মাংস প্রক্রিয়াকরণ করে নিজ নিজ ঠিকানায় ডেলিভারি নিতে পারবে।

 

ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিনে কয়েকটি টিমের নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রমের ফসল আজকের এ ডিজিটাল হাট। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত গরুর হাটগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শহরের পাশঘেঁষে কয়েকটা মাত্র হাটে গরু বিক্রি হবে এবার।

 

তিনি গরুর হাটে নগরবাসীকে যতটা সম্ভব কম যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, আমরা ডিজিটাল হাটের আওতায় গরু বিক্রি ছাড়াও প্রায় দুই হাজার গরু জবাই করে মাংস প্রক্রিয়ার পর বাসায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা রেখেছি।

 

শুধু রাজধানী নয়, কুমিল্লায়ও এবার হাটের পরিবর্তে অনলাইনে পশু ক্রয়-বিক্রয়ে জেলা প্রশাসন ও জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর অ্যাপ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। কুমিল্লা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, করোনার কারণে এ বছর অনলাইনে বেশিরভাগ পশু বিক্রি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

 

কুমিল্লা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অনলাইনে পশু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য জেলা প্রশাসন ও জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উদ্যোগে একটি অ্যাপ চালু করা হবে। হাটে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। তাই কুমিল্লার খামারিরা এ বছর অনলাইনে পশু বিক্রির দিকে ঝুঁকছেন।

 

জেলার অন্যতম বড় খামারি দাউদকান্দির মা ফরিদা ডেইরি অ্যান্ড এগ্রোর স্বত্বাধিকারী মাহতাব পিংকু বলেন, এ বছর খামারে ১৪৯টি গরু কোরবানির জন্য মোটাতাজা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪৯টি গরু অনলাইনে বিক্রি হয়েছে। বিক্রিত পশু ঝামেলা ছাড়াই বিনা খরচে বাড়ি পৌঁছে দেবেন তিনি।

 

চট্টগ্রামের শিকলবাহা এলাকার পশুর ফার্ম শাহ আমানত এগ্রোর মালিক মো. আখতার হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে ৩০টি পশু বিক্রি হয়েছে অনলাইনে। আশা করছি, গত বছরের চেয়ে এবার কয়েকগুণ বেশি পশু বিক্রি হবে। এ খামারে সর্বনিম্ন ৭৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ চার লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় শতাধিক ব্যবসায়ী এখন অনলাইনে কোরবানির পশুর ব্যবসা করছেন। ব্যবসায়ীরা ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপে পশুর ছবি পোস্ট দিয়ে সঙ্গে ওজন ও দাম লিখে দিচ্ছেন। ক্রেতাদের পছন্দ হলে মুঠোফোনে কথা বলে সরাসরি ফার্মে এসে পছন্দের গরু কিনছেন। অনলাইনের এ হাটে কোনো ঝক্কিঝামেলা নেই। কোরবানির ডিজিটাল হাট এরই মধ্যে মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

 

ক্রেতারা বলছেন, এ হাটের পরিসর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে জনপ্রিয়তাও। পটিয়ার ক্রেতা আবদুর রাজ্জাক বলেন, অনলাইনে গত বছরও গরু কিনেছি। হাটে গরু কিনলে অনেক সময় ঠকতে হয়। কিন্তু অনলাইনে প্রতিষ্ঠিত ফার্ম থেকে গরু কিনলে ওজনসহ সবদিক হিসাব করে কেনা যায়। করোনার কারণে এবার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের পাশাপাশি অনেক খামারি ফেসবুকে পেজ খুলে গরু বিক্রির বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন।

 

বিভিন্ন জেলা-উপজেলার খামারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যে অনেকেই অনলাইনে গরু-ছাগলসহ কোরবানির পশু বিক্রি শুরু করেছেন। এবার কোরবানির হাট কেমন হবে তা অনেকেরই অজানা। তাই অনলাইনে পশু দেখে অনেকে খামারে যাচ্ছেন, পশু দেখছেন, ওজন করছেন। এরপর পছন্দ হলে পেমেন্ট দিচ্ছেন। কোরবানির একদিন বা দুদিন আগে খামার কর্তৃপক্ষ পশু বাসায় পৌঁছে দেয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। অসংখ্য কৃষক, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন খামারি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফেসবুকের মাধ্যমে চালু করেছে অনলাইন হাট ও কোরবানির গরুর মেলা।

 

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ই-ক্যাবের সদস্যভুক্ত একশরও বেশি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম কোরবানির পশু বিক্রি করছে।

 

এবার টানা ষষ্ঠবারের মতো অনলাইনে কোরবানির হাটের আয়োজন করেছে বেঙ্গল মিট। অনলাইন হাট থেকে ক্রেতারা সহজেই স্টেরয়েড, এফএমডি, এনথ্রাক্স ও গ্রোথ হরমোনমুক্ত সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুস্থ কোরবানির গরু কিনতে পারবেন। এছাড়া উন্মুক্ত স্থানে কোরবানি ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রসেসিংয়ের পরিষেবায় গ্রাহকদের জন্য রয়েছে হালাল কোরবানি ও বিশ্বমানের নিরাপদ খাদ্য নীতিমালা অনুযায়ী মাংস প্রসেসিং এবং ডোর-স্টেপ ডেলিভারি সুবিধা।

বেঙ্গল মিটের মার্কেটিং, সেলস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনের জেনারেল ম্যানেজার শরফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বেঙ্গল মিট যেভাবে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাংস জোগান দিয়ে আসছে, সেই ধারাবাহিকতায় এবারও অনলাইন কোরবানি হাটের আয়োজন করেছি। করোনা পরিস্থিতিতেও এ বিশেষ ব্যবস্থায় মানুষের জন্য অত্যন্ত নিরাপদে কোরবানির আয়োজন করে তাদের সেবা দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।

 

করোনাভাইরাসের সংক্রমণঝুঁকি এড়িয়ে ঘরে বসেই ক্রেতার হাতে কোরবানির পশু পৌঁছে দিতে ‘অনলাইন কোরবানি মেলাথ চালু করেছে দেশের জনপ্রিয় ই-কমার্স সাইট ‘অথবা ডটকমথ। ক্রেতারা পছন্দ অনুযায়ী কোরবানির পশু অর্ডার করলে নির্দিষ্ট সময়ে তা পৌঁছে দেবে অথবা ডটকম।

 

কোরবানির পশুর জন্য অথবা ডটকমের সাইটে ২৫ জুলাই পর্যন্ত অর্ডার করা যাবে। এছাড়া অথবা ডটমের হেল্প লাইন ০৯৬১৩৮০০৮০০ ফোন করেও কোরবানির পশুর অর্ডার করা যাবে।

 

‘অথবা ডটকমথ-এর হেড অব বিজনেস মাহমুদুল হক উল্লাস বলেন, করোনার সময়ে যারা ভিড় ঠেলে দরদাম করে হাট থেকে পশু কিনে আনার ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চান, তাদের স্বস্তি দিতে আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি।

 

বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও ঈদের আগে কোরাবানির পশুর হাট বসছে অনলাইন বিকিকিনির ক্লাসিফায়েড ওয়েবসাইট বিক্রয় ডট কমে। ষষ্ঠবারের মতো সাইটটিতে নানা রঙের এবং সাইজের পশু বিক্রি হচ্ছে। দেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে যে কেউ এখানে পশু কেনা-বেচা করতে পারছেন। বিক্রয় ডট কম থেকে পশু কিনলে লোকাল এরিয়ায় ফ্রি ডেলিভারি পাবেন গ্রাহক। এছাড়া পেইড ডেলিভারি সিস্টেম রয়েছে সারাদেশে। গ্রাহকের সুবিধার্থে মাংস প্রসেসিং করে তা হোম ডেলিভারি দেয়া হবে।

 

বিক্রয় ডট কমের বিরাট হাটে গরু কেনা-বেচায় রয়েছে ক্যাশ অন ডেলিভারি সুবিধা। এছাড়া ক্রেতার সুবিধার্থে কেউ যদি ভাগে কোরবানি দিতে চান ভাগিদার খুঁজে দেয়ার ক্ষেত্রেও সাহায্য এবং প্রসেসিং করে তা হোম ডেলিভারিরও ব্যবস্থা রেখেছে বিক্রয় ডট কম।

 

দারাজ গত ৩ জুলাই থেকে গরুর হাটে প্রি-পেমেন্টের মাধ্যমে অর্ডার নেয়া শুরু করেছে। ২৫ জুলাই পর্যন্ত এটি চলবে। ক্রেতাদের বাড়িতে ডেলিভারি দেয়া শুরু হবে ২৭ থেকে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে। তবে দারাজের এ হাটের পশু কেবল ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসীরা নিতে পারবেন।

 

দারাজ বাংলাদেশ লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ মোস্তাহিদাল হক বলেন, ‘গত ঈদগুলোর চেয়ে এ বছরের কোরবানি ঈদ একটু আলাদা। করোনার মধ্যে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি ক্রেতাদের সুরক্ষিত রেখে চাহিদা মেটানোর। এ জন্যই অনলাইন গরু হাটের আয়োজন।

 

বাংলাদেশ ডেইরি ডেভেলপমেন্ট ফোরামের (বিডিডিএফ) সাধারণ সম্পাদক ও দেশের বৃহত্তম এগ্রো ফার্ম ‘সাদিক এগ্রো লিমিটেডথর মালিক ইমরান হোসেন বলেন, এবার পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে হাট বসানোর চিন্তা না করে অনলাইন এটিকে কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায় তা নিয়ে ভাবা উচিত। তবে অনলাইনে ব্যবসার নামে কেউ যেন প্রতারণা করতে না পারে সেটাও দেখভাল করা দরকার।

 

তিনি বলেন, এবার ঢাকাসহ সারাদেশের সাদেক এগ্রো ফার্মের আটটি শাখায় প্রায় ১৬০০ গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সব গরুই বিক্রি হবে অনলাইনে। ইতোমধ্যে বিক্রি শুরু হয়েছে। ঈদের দু-একদিন আগে গ্রাহকের বাসায় পৌঁছে যাবে গরু।

 

ঢাকার অদূরে বছিলা গার্ডেন সিটির পাশে গরুর ফার্ম ‘মেঘডুবি এগ্রো-৪। সারাদেশে তাদের ১৪টি শাখা রয়েছে। এ খামারের কর্ণধার নাহিনুর রহমান নাহিন বলেন, আমাদের খামারে মোট তিন হাজার গরু প্রস্তুত করা হচ্ছে। শুধু কোরবানিতে নয়, বছরজুড়েই এখান থেকে গরু বিক্রি হয়। ২০১৪ সালে খামার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আমরা কখনও হাটে গরু বিক্রি করিনি। অনলাইনে পশু দেখে অনেক ক্রেতা পরিবারের লোকজন নিয়ে গরু কিনতে আসেন। ফার্মের গরু দেখার জন্য একটা গ্যালারি করা হয়েছে। গ্যালারিতে ক্রেতারা সব গরুই দেখতে পারেন। এরপর যেটা পছন্দ হয় সেটা তাদের সামনে এনে দেখানো হয়। পছন্দ হলে পেমেন্ট দিয়ে চলে যান।

 

এক প্রশ্নের জবাবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. আবদুল জব্বার শিকদার বলেন, যেহেতু এবার পরিস্থিতিটা অস্বাভাবিক, সে কারণে অনলাইনে বিক্রির সংখ্যা অন্য বছরের তুলনায় বাড়বে। কারণ এই পরিস্থিতিতে ভিড় ঠেলে অনেকে বাজারে যেতে চাইবেন না। এছাড়া এখন অনলাইনে গরুর ছবি দেখা যায়, ওজন জানা যায়, এমনকি পশুর মাংস কত কেজি হবে সেটাও জানা সম্ভব।

 

তিনি বলেন, দেশে এখন বেশকিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেখানে অনলাইনে বা ক্রেতারা পরিবারের লোকজন সঙ্গে নিয়েও পশু কিনতে পারেন। এখন থেকে কোরবানির পশু কিনলে কেউ ঠকবেন না।

 

Facebook Comments Box
  • Untitled post 14630
  • Untitled post 14225
  • Untitled post 11155
  • Untitled post 14630
  • Untitled post 14225