, , , ,

জিপিএ-৫ পেয়েছে বাবা-মা হারানো হাফসা” থামছেনা কান্না

বিশেষ প্রতিবেদক, বরগুনাঃ
জিপিএ-৫ পেয়েছেন মর্মান্তিক লঞ্চ দুর্ঘটনায় বাবা-মা-ভাই হারানো হাফসা। আগামীকাল (শুক্রবার) হওয়ার কথা ছিলো তার বিয়ে। সব আনন্দই ভেসে যাচ্ছে চোখের পানিতে। হাফসারই এখন দায়িত্ব নিতে হবে ছোট দুই ভাই-বোনের। ভূমিহীন পরিবারের সন্তান হাফসার পক্ষে কি এতবড় দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে? গত ৭ দিনেও নিকটাত্মীয় ব্যতিত আর কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। এখনো পায়নি কোন সরকারি সহায়তা।
বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের দক্ষিণ বড় লবনগোলা গ্রামের হাকিম শরীফ (৫০) ও পাখি বেগম (৩৫) দম্পতি। তারা চার সন্তানকে বাবা-মা ও শ্বশুর-শাশুড়ির উপর চাপিয়ে দিয়ে চরম দরিদ্রতার মুখোমুখি হয়ে একসময়ে কাজের সন্ধানে আশ্রয় নেন ঢাকা শহরে। স্ত্রী পাখি বেগম ঢাকার কোন এক গার্মেন্টসে কর্মসংস্থান খুঁজে নেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসএমসি ওরস্যালাইন কোম্পানিতে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে চাকরি নেন হাকিম শরীফ। স্বামী স্ত্রী দুজনের আয়-উপার্জনে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। অনেক স্বপ্ন ছিল এই দম্পতির। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করবে, মানুষের মত মানুষ হবে। নিজেদের উপর যতই পরিশ্রম করা লাগুক না কেন সন্তানরা কখনোই অভাব-অনটনের মুখোমুখি না হয় এই ব্রত নিয়েই তারা একনিষ্ঠভাবে কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন।
বড় মেয়ে হাফসা এবছর বরগুনার সদর উপজেলার কালীরতবক দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। পার্শ্ববর্তী উপজেলা বেতাগীর সরিষামুড়ি ইউনিয়নে ঢাকার একটি বায়িং হাউজে কর্মরত পাত্র দেখে রেখে রেখেছিলেন অভিবাবকরা। আগামীকাল শুক্রবার উভয়পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে বিয়ের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছিলো।
ঢাকার কোন একটি ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা উত্তোলন এবং মেয়ে হাফসার বিয়ের কেনাকাটা করতে ২০ ডিসেম্বর আড়াই বছরের শিশুপুত্র নাসিরুল্লাহকে নিয়ে ঢাকা যান পাখি বেগম। ঢাকাতে বিয়ের কেনাকাটা সেরে ২৩ ডিসেম্বর স্বামী হাকিম শরীফ ও আড়াই বছরের পুত্র নসরুল্লাহকে নিয়ে অভিযান-১০ লঞ্চে ওঠেন পাখি বেগম। সাথে বিয়ের অনেক মালামাল এবং নগদ টাকা থাকায় তারা লঞ্চের স্টাফ কেবিন ভাড়া নেন।
২৩ ডিসেম্বর রাত তিনটার দিকে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে অসংখ্য যাত্রী হতাহত হয়। ইতোমধ্যেই প্রায় অর্ধশত লাশ উদ্ধার করা হয় এবং অগ্নিদগ্ধ জীবিত অনেকেই ঝালকাঠি বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বরগুনা হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অনেকেই লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরিয়ে জীবন রক্ষা করতে পেরেছেন। রয়েছেন অনেক যাত্রী নিখোঁজ।
অভিযান-১০ লঞ্চের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই নিখোঁজ রয়েছেন বরগুনা সদর উপজেলার দক্ষিণ বড় লবনগোলা মানিকখালী গ্রামের আব্দুল হাকিম শরীফ, তার স্ত্রী পাখি বেগম এবং তাদের আড়াই বছরের পুত্রসন্তান নসরুল্লাহ।
২৪ ডিসেম্বর সকালে পাখি বেগমের মা ফরিদা বেগম প্রতিবেশিদের নিকট জানতে পারেন লঞ্চের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের খবর। এই দুর্ঘটনার খবর শুনেই ফরিদা বেগম অব্যাহতভাবে মোবাইলে ফোন দিতে থাকেন জামাই হাকিম শরীফ ও তার মেয়ে পাখি বেগমকে। বহুবার ফোন করে ব্যর্থ হওয়ার পর রওনা দেন ঘটনাস্থল ঝালকাঠিতে। সেখানে পৌঁছে অগ্নিকাণ্ডের এই ভয়াবহতা এবং ভস্মীভূত লাশের স্তুপ দেখে মেয়ে জামাই বা নাতি কাউকেই শনাক্ত করতে পারেননি। ফরিদা বেগমের সাথে খোঁজাখুঁজির কাজে যোগ দেন পাখি বেগমের একমাত্র ভাই নজরুল ইসলাম ভগ্নিপতি জসীম উদ্দীন, শরিফুল ইসলাম সাগর, শফিকুল ইসলাম, হাকিম শরীফের ভাই মোতালেব, রশিদ, সালামসহ আরো অনেকে। তারা নাওয়া-খাওয়া ঘুম হারাম করে একটানা দুই দিন বরিশাল ঝালকাঠি বরগুনা বেতাগী সহ বিভিন্ন হাসপাতালে খুঁজতে থাকে হাকিম পাখি নসরুল্লাহকে।
পাখি বেগমের মা ফরিদা বেগম অগ্নিদগ্ধ অভিযান লঞ্চের স্টাফ কেবিনের ভস্মীভূত ছাইয়ের মধ্যে খুঁজে পান মেয়ে পাখি বেগমের ওড়না, অক্ষত কিছু জামাকাপড়, নাতিদের জন্য কেনা জামা প্যান্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো আংশিক পোড়া। ফরিদা বেগমের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সংগৃহীত একাপড়-চোপড় গুলো মাঝে মাঝে খুলে দেখেন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার বিলাপ সহ্য করার মতো নয়।
দক্ষিণ বড় লবনগোলা গ্রামের নিখোঁজ আব্দুল হাকিমের বাড়িতে গেলে দেখা হয় হাকিম শরীফ-পাখি বেগম দম্পতির অবুঝ আর তিন সন্তানের। এরা হলেন সুমাইয়া (১৪), ফজলুল হক (১০) ও হাফছা বেগম (১৮)। তিনজনই মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থী। বৃহস্পতিবার পরীক্ষার ফল জানার পরই হাফসা শুরু করেছেন কান্না। সেই কান্না থামানো যাচ্ছেনা।
Facebook Comments Box
  • Untitled post 14630
  • Untitled post 14225
  • Untitled post 11155
  • Untitled post 14630
  • Untitled post 14225