সচেতনতাই করোনা জয়ের প্রধান অস্ত্র

বিশ্বব্যাপী এক আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস। করোনা এখন অভিসপ্ত নামও বটে। বিশ্বব্যাপী এক প্রকার যুুদ্ধই চলছে বলা যায় যার এক প্রান্তে সকল দেশের জনগণ আর অপর প্রান্তে করোনা। যুদ্ধে তবু একটি স্বস্তির জায়গা থাকে কিন্তু করোনার কাছে কেউ যেন স্বস্তি পাচ্ছে না। সকলের মধ্যে কাজ করছে মানসিক চাপ।

করোনার ভয়াল ধাবার শিকার বিশ্বের প্রায় ২১০টি দেশ। আর করোনার প্রভাব পরেছে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও অর্থনীতিসহ সকল কিছুর উপর। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর সারি। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না এই মৃত্যুর মিছিল। বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোও করোনার কাছে আজ পরাজিত। করোনা বদলে দিচ্ছে জীবন ও জীবিকার ধরণ।

দীর্ঘসময় কর্মহীন হয়ে করছে মানুষ অসহায় জীবন। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঝরে পরছে বা পরতে পারে শিক্ষার্থীর পড়ালেখা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে ৩ জুলাই শুক্রবার পর্যন্ত মোট ১৫৬৩৯১ জন আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ১৯৬৮ জন। কয়েকদিন যাবৎ সনাক্তের সংখ্যা তিন হাজারের নিচে নামছে না যা চিন্তার বিষয়। আর কয়েকদিনে মধ্যে মৃত্যু সংখ্যাও পার করবে দুই হাজারের ঘর।

গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পরে। তারপর থেকেই চলছে করোনার তান্ডব। করোনাকালে আমার দেখা সেরা সহযোগীতা পাচ্ছে দেশের মানুষ, যা আমাদের জন্য অলঙ্কার। সরকার এই সংকটময় সময়ে যা দিয়েছে তা মাইলফলক। কিন্তু এই অলঙ্কারের সময়ে জনমনে দেখা দিচ্ছে একটি বিষাদময় সংবাদ। করোনা নিরাময়যোগ্য নয় বা করোনা অর্থই সে সমাজের নিকৃষ্ট এমন প্রবণতা লক্ষ্য করছি। আমার মনে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তেই একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

পত্র-পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলে অনেক খবরই দেখছি যে, করোনা রোগীকে খাবার দিচ্ছে না। করোনা রোগীকে ঘর ভাড়া দিচ্ছে না। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো করোনা রোগে কেউ মারা গেলে তার পরিবারের সাথে কেউ যোগাযোগ করছে না। মনে হচ্ছে করোনা হওয়া অর্থই সে যেন সমাজের নিকৃষ্ট মানুষে পরিণত হয়েছে। যার কারণে অনেকে এই রোগে আক্রান্ত  হলেও কাউকে বলছে না। মনে হচ্ছে এই রোগটা হওয়া অর্থই যেন নির্ঘাত মৃত্যু আর সমাজ থেকে বিচ্ছেদ। কিন্তু কেন? আসলে কি এই রোগটি এমন? আমরা বাংলাতে ভাবসম্প্রসারণ পড়েছি, ‘পাপকে ঘৃনা করো, পাপীকে নয়।’

অর্থ্যাৎ একজন যদি চুরি করে তাহলে তার সেই চুরি বিদ্যাকে ঘৃণা করতে হবে। কারণ সেই চুরি করাটা মহাপাপ। কিন্তু আমরা যদি চোরকে ঘৃণা করি তাহলে সে কখনও ভাল পথে আসবে না। সে যদি ভাল পথে না আসে তাহলে কিন্তু সমাজে চুরির ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তাহলে বিষয়টা কি হলো? তাকে কিন্তু ভাল হবার সুযোগ দেওয়া হলো না। সামাজিকভাবে সে যেন এই অপরাধে জড়িত না থাকে সেটা বলা যেতে পারে বা শাস্তি দেওয়া যেতে পারে কিন্তু তাকে অবহেলা করার মধ্যে কোন কৃতিত্ব আছে বলে আমার মনে হয় না। বরং চোরকে যদি কেউ কোন পরামর্শ দিয়ে ভাল পথে আনতে পারে সেটাই সফলতা। করোনার ক্ষেত্রেও কিন্তু একই পরামর্শ।

একজন করোনা আক্রান্ত রোগীতো মহাপাপীও না অপরাধীও না। এটা প্রাকৃতিক কারণে হচ্ছে। তাহলে তাকে  তাচ্ছিল্য করার কোন কারণতো আমি দেখি না। হোমকোয়ারেন্টাইনে থাকা অর্থ সে অপরাধী নয়। যে রোগের যে চিকিৎসা। করোনা রোগে কেউ আক্রান্ত হলে তাকে আলাদা রাখা উচিত কারণ তার সাথে কারো সংস্পর্শ হলে রোগের বিস্তার ঘটতে পারে বা বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রোগটি সংক্রমিত হতে পারে।

রোগীর সুস্থ্যতা ও পরিবারের সুস্বাস্থ্য চিন্তা করে এই প্রতিকার। তাহলে কেন করোনা হলেই সমাজের নিকৃষ্ট মানুষ তাকে ভাবা হচ্ছে? আমার মনে হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তেই এমন প্রচার-প্রচারণা বা প্রবণতা রয়েছে বিশেষ করে গ্রামে এটি বেশি ভাবা হচ্ছে কারণ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর। কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষেরই স্ব স্ব মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার রয়েছে। তাছাড়া এমন প্রবণতার কারণে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক বা চাপ কাজ করছে।  ফলে আগে থেকেই অসুস্থ রোগীরা এই মনোবৃত্তি করতে করতে মারা যাচ্ছে বা যেতে পারে। আমার মনে হয় আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। করোনায় আক্রান্ত্রকারী নয় বরং এই সংকটময় সময়ে যারা চাল চুরি বা জনগণের টাকা পকেটে রেখে পকেট ভারী করছে তাদের ঘৃণা করা উচিত।

আমরা যদি চাল চোরকে ঘৃণা না করে সঙ্গ দিতে পারি, সমাজে ধর্ষণ করে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি তাহলে করোনারোগী কেন অপরাধী হবে? সে কি করোনা নিজে সৃষ্টি করেছে, সে কি ইচ্ছে করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে? প্রত্যেকেরই কিন্তু নিজ নিজ জীবনের মূল্য আছে। করোনা একটি রোগ এবং এই রোগ নিমর্ূল করা যাবে না তাও না। আপনারা অনেকেই দেখেছেন এই রোগ থেকে বিশ্বের অনেক দেশের অনেকেই সুস্থ হয়েছে।

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে ৩ জুলাই শুক্রবার পর্যন্ত মোট  সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৬৮০৪৮  জন।  বর্তমানে করোনা রোগীই বেশি মূল্যবান আমার মনে হয়। গণমাধ্যম করোনার জন্য আলাদা বার্তা বিভাগ করেছে বা গুরুত্ব্সহকারে করোনার সার্বিক অবস্থা তুলে ধরছেন। বিবেচনায় বলে করোনায় আক্রান্ত্রকারীকে এখন আমাদের বেশি মূল্যায়ন করা উচিত তার ও আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য। সঠিক নিয়ম ও সর্তকতা অনুসরণ করলে করোনা বাংলাদেশে তেমন ক্ষতি করবে না বলে আশা করা যায়।

চীনা গবেষণায় বলা হয়েছে, উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমের সময় করোনা ঝুঁকি কমে যাবে। উত্তর গোলার্ধ বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে। উইকিপিডিয়া বলছে, বাংলাদেশের অবস্থান উত্তর গোলার্ধে। আর এই গোলার্ধে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে কমে যাবে করোনার ঝুঁকি। তাই সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশে করোনার ঝুঁকিটা কিছুটা হলেও কম হবার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকদিনে পরিসংখ্যান দেখলে মনে হয় করোনা সহজে মুক্তি দিবে না প্রিয় এই দেশকে। করোনার গতি উর্দ্ধদিকে।

ঝুকিপূর্ণ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এর কারণ কিন্তু আমাদের অসচেতনতা বলে মনে করি। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মানছি না, নিরাপদে চলছি না। সকলের আচরণে মনে হচ্ছে করোনা আর বাংলাদেশে নেই। এমন অসচেতনতা অপ্রত্যাশিত। প্রত্যাশা করি সকলে মিলে সচেতনতার মাধ্যমে করোনার বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দেবার।

প্রকৃতির এই ভয়াল ভাইরাসে কারো উপর দোষ না চাপিয়ে করোনা আক্রান্ত্রকারীকে ঘৃণা না করে সকলে মিলে আইন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। আইন না মানা এক প্রকার গুরুত্বর অপরাধ। আর আইনতো আমাদের জন্যই। একসময় দেশে ক্যান্সার হলে, যক্ষা হলে রক্ষা ছিল না। এখন এই মরণব্যাধীরও ঔষধ বের হয়েছে। এখন আর যক্ষারোগীকে কেউ আলাদা মনে করে না। তাই করোনা আক্রান্ত্রকারীও আলাদা নয়। আমরা করোনা আক্রান্তকারী পরিবারের প্রতি সদয় হয়, তাদের খোঁজ-খবর নেই।

করোনা দূর করতে শক্তি ও সাহস দেই। পাশাপাশি করোনা যেন আমাদের মাঝে দুরত্বের সৃষ্টি না করে আমাদের সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমরা সাময়িক সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারি। তবে এই অজুহাতে আমরা যেন নির্দয় না হয়। বরং করোনার কারণে আমাদের মাঝে যাদের দূরত্ব আছে তাদের করোনা পরবর্তীকালে একত্রিত হতে হবে। কারণ এই করোনা আমাদের শিখিয়ে যাচ্ছে রাগ-হিংসা-ঈষার্ কোনটাই আমাদের নয়। এই মন্দ অভ্যাসগুলো আমাদের কোন ভাল কিছু করতে সাহায্য করে না। ক্উে কি এমন সংবাদ পেয়েছেন কোন এলাকায় কোন মানুষের হিংসার কারণে করোনা থেকে মুক্তি পেয়েছেন? পাই নাই কিন্তু বরং কোন অসামাজিক মানুষ করোনায় মারা গেলে লোক মুখে প্রচার হবে লোকটি খুব অসামাজিক ছিল তাই সৃষ্টিকর্তা তাকে তুলে নিছেন। এই যে সমাজের মন্দ অভ্যাস আসুন আমরা করোনার সাথে দূর করি।

সমাজের এই অসঙ্গতিগুলো দূর করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের সকলের। বিশেষ করে সমাজের গুণীজন বা দায়িত্বশীল সুনাগরিক রয়েছে আমাদের সকলের উচিত যারা করোনাকে নিয়ে এমন প্রবণতার পরিচয় দিচ্ছে তাদের বোঝানো। করোনা অর্থ কলঙ্কিত নয়। করোনা রোগ নিরাময়যোগ্য।  শুধু করোনা নিয়েই নয়, সমাজের সকল অসঙ্গতির বিষয়ে সঠিক পরামর্শ তুলে ধরা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমার মনে হয় করোনা নিয়ে এই বিকৃত তথ্য আরও বাড়তে থাকবে।

তবে এমন অসচেতনতামূলক কথা বাড়তে দেওয়া যাবে না। করোনারোগীর মনোবল হারানো যাবে না।  করোনা থেকে শিক্ষা নেই, সকলে মিলে হাতে হাত রেখে পাপকে ঘৃণা করে, রোগীকে ভাল পথে সুস্থ জীবন গড়তে উৎসাহিত করি। তাহলেই সমাজে বিস্তৃতি পাবে না অপসংস্কৃতি বা অসঙ্গতি। সকলের মর্যাদা হবে সমান। সরকারের প্রতি অনুরোধ করোনা রোগীর সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা  রক্ষায় সচেষ্ট থাকুন। করোনার গুজব বা আইন লংঘন বা ঘৃণা এগুলো কারোই কাম্য নয়। মনে রাখতে হবে নমুনা সংগ্রহ করলেও সে করোনা আক্রান্তকারী নাও হতে পারে । কারণ পরীক্ষা করা হয়েছে অনেকের সকলেই কিন্তু রোগী নয়। রোগী তারাই যাদের প্রশাসন থেকে চি‎িহ্নত করা হবে। মানুষের জীবন অর্থই সুখ-দুঃখ, রোগ-ব্যাধী সুস্থতা সবকিছু মিলে। রোগ হলেই টেনশন বা দুঃচিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক তবে যে সকল রোগের চিকিৎসা আছে সেগুলো নিয়ে দুঃচিন্তার আমি ঘোড় বিরোধী। কারণ দুঃচিন্তা রোগকে মহামারীতে পরিণত করে। বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির কারণে কোন রোগই আর রোগ নয়।

যেকোন রোগেরই স্বাস্থ্যবিধি বা ঔষধ খেলে মুক্তি মেলে। কিন্তু বিভিন্ন রোগে আমাদের অতিরঞ্জিত মনোভাব আমাদের ক্ষতির কারণ বলে আমার মনে হয়। করোনারোগীকে সাহস ও শক্তি দেই। সুস্থ হতে সহযোগীতা করি। আমি আবারও বলছি করোনারোগ নিরাময়যোগ্য। সচেতনতাই এর মূল অস্ত্র।  করোনা অর্থ ঘৃণা নয়। করোনা অর্থ সচেতনতা হোক। আসুন আমরা আরও মানবিক হই। সচেতনতা ছাড়া করোনামুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। সচেতনতায় করোনা জয়ের প্রধান অস্ত্র। সকলে সচেতন হই ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি।

“গোপাল অধিকারী”

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

 

Facebook Comments Box
  • Untitled post 14630
  • Untitled post 14225
  • Untitled post 11155
  • Untitled post 14630
  • Untitled post 14225