বাবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধি, ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায় জুঁই

বাবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধি,তাতে কি জীবন তো আর থেমে থাকে না। অভাবের সংসার তাই জীবিকার তাগিদে রিক্সা-ভ্যান চালায় জুই মনি। কোমল হাতে ব্যাটারিচালিত ভ্যানের হ্যান্ডেল নিয়ন্ত্রণ করেই চলছে তার বেঁচে থাকার লড়াই।

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে শিশু জুই মনি ভ্যানগাড়ী চালিয়ে জীবিকার লড়াই করছেন। জুই মনি দক্ষিণ মধ্যপাড়া কমিউনিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। জুই মনির বয়স ১০ বছর। ভ্যান চালিয়ে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে চলে তাদের সংসারের খরচ।

জুই মনির বাড়ি পার্বতীপুর উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের আকন্দ পাড়া গ্রামে। তার পরিবারে ৫ সদস্য। বাবা জন্ম থেকে চোখে অল্প অল্প দেখতো আর বনের পাতা কুড়িয়ে সংসার চলতো। ৩ বছর ধরে চোখে আর কিছু দেখতে পায়না জুই মনির বাবা জিয়াউল হক (৪২),স্বাভাবিক চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। ৩ বছর আগে জিয়াউল বনের পাতা কুড়িয়ে সংসার চালাতেন। চোখে দেখতে না পারায় পর অচল হয়ে পড়েন তিনি। অথই সাগরে পড়ে সংসার।

এরই মধ্যে বড় মেয়ে রোমানা আক্তারের বিয়ে হয়ে যায়। সংসারের হাল ধরতে দুই বছর হলো ছোট মেয়ে জুই মনি শুরু করে ভ্যান গাড়ি চালানো। জিয়াউল হকের দাবি, চোখে দেখতে না পারায় আমি অচল। এক বেলা খেলে, আরেক বেলা তাঁদের না খেয়ে থাকতে হয়। এমন অবস্থায় ছোট মেয়ে জুই ভ্যান চালাতে শুরু করেছে।

মধ্যপাড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, জুই মনি ব্যাটারিচালিত ভ্যানগাড়ি নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় রয়েছে। জুই জানায়, গাড়ি ভালোই চালায় সে। ভাড়া নিয়ে পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী ও বদরগঞ্জ শহরের বিভিন্ন স্থানে যায়। এভাবেই চলছে তার জীবনযুদ্ধ। জুই মনিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বন বিভাগের জায়গায় টিন দিয়ে ঘিরে ঘর বানিয়েছে। সেই ঘরে তাদের বসবাস। নিজের এক শতক জমি কিংবা বসতাভিটা নেই।

জুই মনির মা শাহারা বানু বলেন, ৩টি এনজিও থেকে লোন নিয়ে বন বিভাগের জায়গায় এই টিন সেডের বাড়ী করেছেন এবং ভ্যানগাড়ী কিনেছেন। সপ্তাহের ৩ হাজার ৭শ’ টাকা কিস্তি ও পরিবারে সদস্য খচর সবটাই মেয়ে জুঁই চালাচ্ছে। মেয়ের বাবা প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা পায় এই দিয়ে কনো রকমে চলে তাদের সংসার।

তিনি আরও বলেন, ভ্যান চালোনোর কারনে প্রথম দিকে গ্রামবাসী তার মেয়েকে নিয়ে নানা কথা বলত। মেয়ে মানুষ হয়ে ভ্যান গাড়ি চালায়। মেয়েকে বিয়ে করবে কে, তখন খুব খারাপ লাগত। এ নিয়ে ঘরে বসে কান্নাও করতেন। তবে এখন তিনি মেয়ের জন্য গর্ব করেন।

জুই মনি বলে, মা-বাবার কষ্ট দেখে খারাপ লাগত। আমরা ৪ বোন ১ ভাই অনেক সময় না খেয়েও থেকেছি। টাকার অভাবে অনেক সময় মুখে খাবার জুটতো না। পরে নিজেই ভ্যান চালানো শুরু করি।’ ভ্যান চালিয়ে দৈনিক ৩০০ থেকে  সাড়ে ৪০০ টাকা রোজগার হয়। আমার পড়ালেখা করতে ভালো লাগে। শত কষ্ট হলেও পড়ালেখা শেষ করতে চাই। বাবার কোনও জমিজমা নেই। বন বিভাগের জায়গায় আমাদের বাড়ি। এক ঘরে আমি ও অন্য ঘরে বাবা-মা ও ছোট বোন থাকে। আমি যা রোজগার করি তা দিয়ে সংসার চলে। পাশাপাশি লেখাপড়া করছি।

জুই মনির যে স্কুলে পড়ে সেই দক্ষিণ মধ্যপাড়া কমিউনিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, জুঁই অত্তন্ত নম্র, বিনয়ী ও খুব মিশুক মেয়ে। সে লেখাপড়ার পাশাপাশি ভ্যান চালায়। সে ছাত্রী হিসেবে ভালো। এই বয়সে সে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। মেয়ে হয়েও অনেক কিছু করা যায়, সেটার দৃষ্টান্ত জুই। মেয়েটির কাছ থেকে এখনকার ছেলেমেয়েদের শেখার আছে। লেখাপড়াতে ও খেলাধুলায় সে খুব ভালো। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলেন জুই মনির বাবা। হাসপাতাল থেকে তিনি জানতে পেরেছেন, তাঁর চোখের জন্য অপারেশন করতে হবে। অনেক টাকা দরকার। মেয়ের আয়ে কোনোমতে চলে সংসার ও তাঁর চিকিৎসা। চিকিৎসার টাকা কোথায় পাবেন, সেটা ভেবেই দুর্বিষহ দিন কাটছে তাঁদের।

উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের আকন্দপাড়ার গ্রামের ইউপি সদস্য মোঃ রাহিনুল হক বলেন, জুইয়ের পরিবারকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সহযোগিতা করার সাধ্যমতো চেষ্টা করি তবে সমাজের বৃত্তবানরা যদি এগিয়ে এসে তাদের পাশে দাড়ায় তবে ওই পরিবারটির অনেক উপকার হবে বলে জানান তিনি।

Facebook Comments Box
  • Untitled post 14630
  • Untitled post 14225
  • Untitled post 11155
  • Untitled post 14630
  • Untitled post 14225