, , , , ,

কষ্টের দিনে এল খুশির ঈদ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
মহামারীকালে অনেক কিছুই বদলে গেছে। জাতীয় ঈদগাহে প্রধান ফটকের সামনের চিত্র দেখে বোঝার উপায় নেই যে একদিন বাদেই ঈদ। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঈদ করতে ঢাকা ছাড়ছিলেন আবদুল্লাহ আল রানা। ব্যক্তিগত গাড়িতে একদিন আগে যশোরে যান রানা। উদ্দেশ্য বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে ঈদ কাটানো। স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা থেকে রওনা হন তিনি।

তবে রানার এই বাড়ি যাওয়া অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে আলাদা ছিলো। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে গত বছর ঈদ করতে বাড়ি যেতে পারেননি। পরিস্থিতির উন্নতি না হলেও মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে এবার তার যাওয়াই লাগবে, এমনটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার কাছে।

ঢাকায় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাড়িতে বৃদ্ধ মা। ঈদের সময় আমাদের কাছে না পেলে অস্থির হয়ে পড়েন। নিজেদের গাড়ি ছিল বলেই এবার ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি গেছি।”

সাধারণত ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে যশোরে যান রানা। কিন্তু এবার মাওয়ার দিকে যাননি। পাটুরিয়া দিয়ে ফেরি পার হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নেন তিনি। সেখানে অপরিচিত একজনকে আরোহী হিসেবে তুলে নেন গাড়িতে। গাড়ি না পেয়ে ফেরিঘাটে অপেক্ষারত বহু মানুষের মধ্যে ওই ব্যক্তিও ছিলেন।

তিনি বলেন, “মাওয়া ঘাটের ভিড়ের কথা আগেই শুনেছিলাম। তাই পাটুরিয়া দিয়ে চেষ্টা করি। কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা। তখন গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে পাবনা হয়ে যশোরে গেছি।

“পাটুরিয়া ফেরিঘাটের অনেকটা আগেই রাস্তায় এক লোক সাহায্য চেয়েছিল। সেও যশোরে যাবে। তাকে নিয়েই গেছি।”

প্রায় ২০০ কিলোমিটারের জায়গায় ৩৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি পৌঁছান রানা। পথে দেখেন মানুষের ভোগান্তি।

খোলা ট্রাকে ১৭ ঘণ্টা ভোগান্তির পরও বাড়ি ফিরে খুশি

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের চন্দ্রায় ‍বুধবার ট্রাকে করে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির পথে মানুষের ঢল । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ঈদ মানে খুশি; রমজান মাসজুড়ে রোজা রাখার পর মুসলমানদের জন্য উৎসব হয়ে আসে ঈদুল ফিতর।

কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী গত বছর দুই ঈদ উৎসবেরই রাশ টেনে ধরেছিল। পরিস্থিতি এবারও বদলায়নি। সংক্রমণে মৃত্যুর ঝুঁকি আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিহীনতায় জীবন আর জীবিকা দুই সঙ্কট নিয়েই দিনাতিপাত করতে হচ্ছে মানুষকে।

এরমধ্যে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় জীবন বাঁচানোকে গুরুত্ব দিয়ে আবার এসেছে লকডাউন; সেই বিধি-নিষেধের খাঁড়ার মধ্যেই এল ঈদ।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদ পালনের আহ্‌বান

ঈদ জামাত কখন কোথায়

ঈদের সকালে হালকা বৃষ্টির আভাস

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ঢাকার জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে ঈদের জামাত ঘিরে নেই কোনো ব্যস্ততা। গত বছরও জাতীয় ঈদগাহে অনুষ্ঠিত হয়নি ঈদের প্রধান জামাত। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

গত বছরের মতো এবার রোজার ঈদেও নামাজ হবে ঈদগাহে, পড়তে হবে মসজিদে। এক্ষেত্রেও মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি, করা যাবে না কোলাকুলি। জনসমাগম তো নিরুৎসাহিতই করা হচ্ছে। বিনোদন কেন্দ্রগুলোও থাকছে বন্ধ।

সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া এড়াতে ঈদের ছুটিতে সবাইকে কর্মস্থলে থাকতে বলেছিল সরকার। বন্ধ রেখেছে দূরপাল্লার সব যান। কিন্তু তার মধ্যেও ঢাকা ছেড়েছেন লাখ লাখ মানুষ; রানার চেয়ে বেশি বিড়ম্বনা নিয়েও।

আর সাধ থাকা সত্ত্বেও অনেকে আবার ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফেরার মিছিলে শামিল হননি। তাদেরই একজন ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ফারজানা সাকি।

বছরে দুই ঈদের একটি তিনি করেন জয়পুরহাটে শ্বশুর বাড়িতে, আরেকটি বগুড়ায় নিজের বাড়িতে। গত বছর দুটি ঈদই স্বামীসহ ঢাকায় কাটিয়েছেন। এবারও তাই।

‘জীবন আগে’

চলমান পরিস্থিতিতে উৎসবের দিনেও সতর্কতায় কোনো ধরনের ঢিল না দিতে তাগিদ এসেছে রাষ্ট্রপ্রধান মো. আবদুল হামিদ এবং সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার কাছ থেকে।

একজনের অসতর্কতা কীভাবে তার স্বজনের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, ঈদ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

সবার উপরে মানুষের জীবন: প্রধানমন্ত্রী

ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, “মহামারীর কারণে জীবন ও জীবিকা দুটোই আজ হুমকির মুখে। এ কঠিন সময়ে আমি সমাজের স্বচ্ছল ব্যক্তিবর্গের প্রতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি।

“একই সাথে আমি দেশবাসীর প্রতি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপনের আহ্বান জানাচ্ছি।”

বারবার বলার পর স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা উধাও ছিল ঢাকায় ঈদ কেনাকাটায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, “অস্বাভাবিক পরিবেশে আমরা ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপন করছি। আমি অনুরোধ করব, যথাসম্ভব গণজমায়েত এড়িয়ে আমরা যেন ঘরে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করি এবং আল্লাহ্‌তায়ালার দরবারে বিশেষ দোয়া করি যেন এই সংক্রমণ থেকে আমরা সবাই দ্রুত মুক্তি পাই।”

সবার মধ্যে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেছেন, “করোনা মহামারি আমাদের ঈদ আনন্দকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে।”

শুধু বাংলাদেশই নয়, ঈদের উৎসব ম্লান বিশ্বজুড়েই। ইন্দোনেশিয়ায় সব ধরনের চলাচল বন্ধ রেখেছে, মালয়েশিয়া জারি করেছে লকডাউন, পাকিস্তানে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণে ভারত এখন বিপর্যস্ত, দেশটির মুসলমান নাগরিকরাও এর বাইরে নয়।

অন্যদিকে মহামারীর মধ্যে ভিন্ন এক সঙ্কটের মধ্যে ঈদ উদযাপন করেছে ফিলিস্তিনি মুসলমানরা। সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সেখানে ঈদ খুশির বার্তা আনেনি। তারপরও উৎসবের দিনটিতে শোক ভুলে থাকার চেষ্টা দেখা গেছে।

বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়; শত সঙ্কটের মধ্যেও ঈদে উৎসবের রঙে মন রাঙানোর ইচ্ছা থাকে প্রায় সবার।

দুই মিলিয়ে হয় আনন্দ-বেদনার কাব্য, যার উদাহরণ ঢাকার সাত মসজিদ রোডের বিরিয়ানির দোকানের কর্মচারী রিফাত হোসেন।

ঈদে বরিশালে নিজের বাড়িতে ঈদ কাটাতে যাওয়ার ইচ্ছা তার। কিন্তু দোকান যে খোলা। আর দোকান খোলা মানেই আয়। তার পরিকল্পনা ঈদের দিন সকালে বরিশালে রওনা হবেন তিনি।

“ইনকাম কইরা কালই রওনা দিমু,” বলেন তিনি। ইনকামের গুরুত্বটি বুঝিয়ে তিনি বলেন, “বাড়িতে মা, বউ আছে না। বাড়িতে গেলে টাহা তো লাগবেই। ঈদ তো!”

Facebook Comments Box
  • Untitled post 14630
  • Untitled post 14225
  • Untitled post 11155
  • Untitled post 14630
  • Untitled post 14225